করোনার নাম শুনলে এখনও কেমন যেন একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরে। অতিমারি পর্বে যে সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা প্রত্যেকে গিয়েছি এই আতঙ্ক থেকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তার মধ্যে যদি শোনেন এই করোনার হাত থেকে রেহাই পেতে যে টিকা নিয়েছিলেন সেই টিকা বিরল কোনও রোগের ঝুঁকি আপনার জীবনে এনে দিয়েছে! একথা জানলে আমি-আপনি সকলেরও চোখ বড় বড় হয়ে যাওয়ার কথা। তবে আমরা আপনাদের বিভ্রান্ত করছি না, সত্যিই এমন ঘটনা ঘটেছে।
অতিমারির সময় করোনা টিকা কোভিশিল্ড(covishield vaccine) দেওয়া হয়েছে ভারত সহ অনেক দেশের মানুষকেই। এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেকথা স্বীকার করে নিল টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘অ্যাস্ট্রোজ়েনেকা’। এই প্রতিষেধকের কারণে বিরল রোগ ‘থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম’ (টিটিএস)-এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।তাই এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবরে বিশ্বজুড়ে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে।গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতে দেওয়া এক নথিতে জানিয়েছিল ওই টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থা। সূত্রের খবর, এর কারণে ওই সংস্থাকে বিপুল অঙ্কের জরিমানা দিতে হতে পারে।
‘থ্রম্বোসিস উইথ থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া সিনড্রোম’ বা টিটিএস কী?
এই রোগে আক্রান্ত হলে রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ কমে যায় এবং রক্ত জমাট বাঁধে। কমে যেতে পারে প্লেটলেটসের মাত্রাও। রক্তে প্লেটলেটসের মাত্রা কমে গেলে তা শরীরে পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে। মস্তিষ্ক, অন্ত্র, পা, ফুসফুসে রক্ত জমাট বেঁধে যাবে। কমবয়সীদের মধ্যে বেশি এই রোগের ঝুঁকি রয়েছে।
এই রোগে কী উপসর্গ?
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, পেটে যন্ত্রণা, পা ফুলে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা নেওয়ার দেড় মাসের মধ্যে এই সব সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
কেন এমন ঘটছে?
কোভিশিল্ড টিকা নেওয়ার পর যে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেটি পরোক্ষভাবে রক্ত জমাট বাঁধাতে সাহায্য করছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সহযোগিতায় এই প্রতিষেধক তৈরি করেছিল সংস্থাটি। এরপর ঘটনার সূত্রপাত হয় ২০২১ সালে। জেমি স্কট নামে এক ব্যক্তি এই সংস্থার ভ্যাকসিন নেওয়ার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যায় তাঁর। এর পর আরও অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থদের পরিবারের তরফে ‘অ্যাস্ট্রোজ়েনেকা’র বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের হয়। তখন থেকেই মামলা চলছে। বিভিন্ন কাগজপত্র, প্রমাণ দেখিয়ে নিজেদের নির্দোষের প্রমাণ করার চেষ্টা করে সংস্থা। মামলা চলাকালীন, আদালত জানিয়ে দেয়, সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ যদি সত্যি হয় তা হলে জরিমানা দিতে হবে। সেটাই সত্যি হল শেষ পর্যন্ত। তীরে এসে ডুবল কোভিশিল্ড প্রস্তুতকারী সংস্থার। আদালতে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হল যে, তাদের তৈরি প্রতিষেধকে কঠিন রোগের ঝুঁকি আছে।
অ্যাস্ট্রোজেনেকার এই স্বীকোরোক্তির পর থেকেই তোলপাড় গোটা বিশ্ব। কোভিড টিকার থেকে বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অর্থাৎ এক মারণ রোগের হাত থেকে রেহাই পেতে বিরল রোগ ডেকে এনেছি আমরা।
এদিকে বিষয়টা বিদেশী সংস্থাতেই থেমে যায়নি, ভারতে ওই একই ফর্মুলার টিকা তৈরি করেছে সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। এবার তাদের বিরুদ্ধেও দায়ের হল অভিযোগ। এক দম্পতি তাদের কন্যার মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন কোভিশিল্ড টিকাকে। অভিযোগ ওই টিকা নেওয়ার পরেই মৃত্যু হয় তাদের কন্যা কারুণ্যার। এটিও ২০২১ সালের ঘটনা। তখন থেকেই সন্দেহ মনে দানা বেঁধেছিল কারুণ্যার বাড়ির লোকের। অ্যাস্ট্রোজেনেকার স্বীকারোক্তির পর সেই সন্দেহ থেকেই অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
অ্যাস্ট্রোজেনেকার পর এবার কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে সিরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়াকে। কী অভিযোগ আনা হয়েছে সিরামের বিরুদ্ধে?
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রোজেনেকার যৌথ ভাবে তৈরি কোভিশিল্ডে বিরল হলেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে একটি হল রক্ত জমাট বাঁধা। অন্যটি হল প্লেটলেটের সংখ্যা কমে যাওয়া। ভেনুগোপালন গোবিন্দানের দায়ের করা অভিযোগে বলা হয়েছে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জেরেই মৃত্যু হয় তাঁদের মেয়ের।
আর এহেন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির দাবি আবার ভিন্ন। তাদের কথায়, কোভিশিল্ডের জেরেই মৃত্যু হয়েছে, এমন অভিযোগের সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তাই টিকার জেরে মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করে না ওই কেন্দ্রীয় কমিটি।কিন্তু এইভাবে কি পিঠ বাঁচানো যায়? আপনি যদি কোনও কাজের কৃতিত্ব নিয়ে থাকেন, আর সেই কৃতিত্বে যদি দাগ লাগে, তার দায়ভার তো আপনাকেই নিতে হবে! তাই নয় কী?
করোনার ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটে মোদির ছবি থাকা নিয়ে একটা সময় দেশজুড়ে বিতর্ক হয়েছে। বিরোধীরা এই ইস্যুতে বারবার আক্রমণ করেছে কেন্দ্রের শাসক শিবিরকে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবার ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটে মোদির ছবি থাকা নিয়ে সরব হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও সার্টিফিকেটে মোদির ছবি রাখার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রক। প্রধানমন্ত্রীর ছবির নিচে একটি ছোট্ট বার্তাও ছিল। বলা ছিল, “আমরা একসঙ্গে করোনাকে হারাব।’’
কিন্তু মজার বিষয়, কোভিশিল্ড নিয়ে বিতর্কের পর নাকি রাতারাতি ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে মোদীর ছবি। সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক নেটিজেনের তেমনটাই দাবি। এখন ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ডাউনলোড করলে তাতে দেখা যাচ্ছে সার্টিফিকেটে সবটাই রয়েছে। “আমরা একসঙ্গে করোনাকে হারাব”, এই বার্তাও লেখা রয়েছে কিন্তু মোদির ছবি অদৃশ্য! বিশ্বাস না হলে আপনিও দেখতে পারেন।
নেটিজেনদের ধারণা, এই বিতর্কের জেরেই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট থেকে মোদির ছবি সরানো হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রক সূত্র সেই দাবি পুরোপুরি নস্যাৎ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রক সূত্র বলছে, কোভিশিল্ড বিতর্কের জেরে নয়। ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট থেকে মোদীর ছবি সরানো হয়েছে কারণ দেশে নির্বাচনী আচরণবিধি কার্যকর হয়ে রয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের এই সাফাইতে বলতেই হচ্ছে… What a co-incidence! এখনই নির্বাচনী আচরণবিধি চলছে দেশে।আচ্ছা, এটাই যদি কারণ হয় মোদীর ছবি উধাও হয়ে যাওয়ার, তবে কি এই বিধি উঠে গেলে আবার মোদীর ছবি করোনা ভ্যাক্সিনের সার্টিফিকেটে দেখতে পাব আমরা? নাকি একেবারেই উধাও হল মোদীর ছবি? ভোটের পর উত্তর মিলবে।
সবশেষে, একটাই প্রশ্ন মোদীর ছবি উধাও নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মুখ কি বন্ধ করতে পারবে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক? তবে যে যাই বলুক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই সুস্পষ্ট হয়ে যাবে সাধারণ মানুষের কাছে।
(বিস্তারিত খবর, সঠিক খবর, গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে ফলো করুন আমাদের X (Twitter), Facebook, YouTube, এবং Instagram পেজ)