রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম
ভক্তরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
ঈশ্বরের সঙ্গে মানব মিলন সম্পন্ন হয় এই রথের দিনে। এই জগতের নিয়ন্ত্রা এই দিন ধরা দেন ভক্তের কাছে। ভক্ত ও ভগবান এক হয়ে যান আজকের এই দিনে। রথযাত্রা হিন্দু সমাজের একটি বাৎসরিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের ২য়া তিথিতে রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর সাতদিন পর শুক্লপক্ষেরই দশমী তিথিতে রখের ফিরতি টান অনুষ্ঠিত হয়। একে বলা হয় উল্টোরথ। রথযাত্রার আগের পূর্ণিমা তিথিতে দেবতার স্নানযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। কেউ কেই বলেন দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে।
এর মধ্যে কয়েকটি কাহিনী আবার এরকম। হিন্দু মতে ‘যখন যখনই ধর্মে সংকট উপস্থিত হয়, চারদিকে অধর্মের উত্থান ঘটে; তখনই দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ভগবান স্বয়ং যুগে যুগে অবতাররূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হন। এমনই এক অবতার ছিলেন দ্বাপর যুগের শ্রীকৃষ্ণ। মহাভারতে বর্ণিত ১৮ দিনব্যাপী কুরু-পাণ্ডবের রক্তঝরা যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠিরের হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে আরোহণের পর, শ্রীকৃষ্ণের ধরাধামে আবির্ভূত হওয়ার আপাতত উদ্দেশ্য সাধিত হওয়ায়, মনুষ্যগুণাবলি সম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণ তার ইহলৌকিক দেহ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
একদিন শ্রীকৃষ্ণ একটি গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। জরা নামক এক শিকারি ব্যাধ দূর থেকে শ্রীকৃষ্ণের লাল পা দু’টি দেখে, লাল পাখি ভ্রমে, তা তীরে বিদ্ধ করলে শ্রীকৃষ্ণ ডাল থেকে নিচে মাটিতে পড়ে যান। আহত শ্রীকৃষ্ণকে দেখে জরাব্যাধ হায় হায় করতে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, এই ঘটনা পূর্ব নির্ধারিত। পূর্বের এক জন্মের তাদের উভয়ের কর্মফলের কারণেই, তার জরাব্যাধের হাতে দেহ ত্যাগের ঘটনা ঘটছে। তথাপি, জরাব্যাধ বারবার অনুশোচনাপূর্বক কৃষ্ণভজনের অনুমতি প্রার্থনা করলে শ্রীকৃষ্ণ জরাব্যাধকে বলেন যে, সে যেন প্রথমে দক্ষিণে গিয়ে পরে পূর্বদিকে সমুদ্র উপক,ল ধরে হেঁটে যায়; এভাবে গিয়ে যেখানে সমুদ্রের জলে সে শ্রীকৃষ্ণের চিতার কাঠ ভেসে যেতে দেখবে, সেখানে সেই কাঠ সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠার পর সে যেন আরাধনার ব্যবস্থা করে। এরপর শ্রীকৃষ্ণ তার লৌকিক দেহ ত্যাগ করেন।
অতঃপর অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের মরদেহ সৎকারের জন্য দ্বারকা না পাঠিয়ে, সমুদ্র উপকূলে দাহ করার জন্য চিতায় উঠিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করেন। জরাব্যাধ শ্রীকৃষ্ণের আদেশনুসারে সমুদ্র উপকূল ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুরীতে এসে পৌঁছন। এদিকে জ্বলন্ত চিতায় মরদেহ সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হওয়ার আগেই সমুদ্রের এক প্রচণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে চিতার আগুন নিভে যায়। কিছু দেহাবশেষসহ চিতার কাঠ সমুদ্রের জলে ভেসে যেতে থাকে। জরাব্যাধ পুরীর কাছে সমুদ্রের জল থেকে শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ সেই কাঠ সংগ্রহ করে গভীর অরণ্যে সেইগুলো স্থাপনপূর্বক দারুব্রহ্ম বা জগন্নাথরূপে আরাধনা করতে থাকেন। এই জরাব্যাধই ছিলেন অরণ্যচারী শবরদের রাজা বিশ্ববসু। দেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের অনুরোধে বিশ্ববসু তদকর্তৃক সংগৃহীত চিতার কাঠ (শ্রীকৃষ্ণের দেহাবশেষসহ) রাজাকে দান করেন। রাজার দেব কারিগর বিশ্বকর্মা সেই কাঠ দ্বারা মূর্তি নির্মাণের ভার গ্রহণ করেন এই শর্তে যে, মূর্তি নির্মাণকালে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না। অনেকদিন চলে যায়, বদ্ধ নির্মাণশালা থেকে মূর্তি নির্মাণের সাড়াশব্দ না পেয়ে অধৈর্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা ভেঙে নির্মাণশালায় প্রবেশ করেন। মূর্তি নির্মাণে এরূপ অনাকাক্সিক্ষত, বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় বিশ্বাকর্মা মূর্তি নির্মাণ অসমাপ্ত (তখন পর্যন্ত মূর্তির হাত-পা-চোখ নির্মিত হয়নি) রেখেই স্থান ত্যাগ করেন।
পরবর্তীকালে ব্রহ্মার আদেশে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ওই অর্ধনির্মিত মূর্তির মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের অস্থি স্বাপন করে মূর্তিতে চক্ষু, দৃষ্টি এবং প্রাণের সংস্থানপূর্বক তা আরাধনার ব্যবস্থা করেন। এই মূর্তিগুলো হলো জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পরিবর্তিত রূপই হল প্রভু জগন্নাথ। অনেকের ধারণা- আদিতে জগন্নাথ তথা নীলমাধব ছিলেন নিম্ন বর্ণের প্রাচীন কোনো জাতি- গোষ্ঠীর, সম্ভবত অরণ্যচারী শবর জাতি-গোষ্ঠীর উপাস্য দেবতা- যারা আদিম সংস্কার ও ঐতিহ্যবশতই বিশ্বাস করতেন, ‘মৃতের অস্থি পুনঃসংযোজন করে নতুন কলেবরে গড়ে তাতে প্রাণ সঞ্চার করা যায় এবং কাঠের মূর্তির মধ্যে বৃক্ষপ্রাণ সঞ্চারিত হয়- আর রথযাত্রা ছিল কৃষির উর্বরতা তন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এক ধরনের সার্বজনীন আনন্দোৎস; যেখানে ধনী-গরিব, উচ্চ-নীচ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবাধ মেলামেশায় মেতে উঠতেন। কারণস্বরূপ বলা যায়, প্রথমত, এটি অনুষ্ঠিত হয় আষাঢ় মাসে, অর্থাৎ বর্ষাকালে, দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণ ছিলেন গো-পালক এবং বলরাম ছিলেন হলধর, অর্থাৎ যিনি হল দ্বারা জমি চাষ করেন। কালক্রমে হিন্দুধর্মের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতায় নিজস্ব ঐতিহ্য উচ্চ-বর্ণের হিন্দুরা জগন্নাথ তথা নীলমাধব দেবতাকে আত্মস্থ করে নিজেদের দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এরূপ গ্রহণের পর শুরুতে ব্রাহ্মণ-শাসিত সমাজে, শুধুমাত্র উচ্চ-বর্ণীয় হিন্দুদের মধ্যে রথযাত্রা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। আর আদিতে নীলমাধব দেবতা যাদের উপাস্য দেবতা ছিলেন, সেই নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের অচ্ছুৎ অন্ত্যজ বলে রথের রশি ধরার অধিকার থেকে তাদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত করে রাখা হয়। ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের ফলে পুরীর রথযাত্রা এক নতুন মাত্রা লাভ করে।
কথিত আছে, পুরীতে একবার রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ রথে আরোহণ করিয়ে রখ যাত্রার জন্য প্রস্তুত। উচ্চ-ধর্মীয় হিন্দু নরনারী, রাজ-কর্মচারীবৃন্দ রথের রশি ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগে টানছেন কিন্তু রখের চাকা অনড। খবর পেয়ে দেশের রাজা প্রতাপ রুদ্র সপরিষদ এসে রথের রশি ধরে আকর্ষণ করতে লাগলেন; তথাপি রখের চাকা স্থির, নিশ্চল। তখন মহাপ্রভু বললেন- যে শবর বা নিম্ন বর্ণের মানুষদের তোমরা অচ্ছুৎ-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছ, তাদের রখের রশি ধরার সুযোগ দাও, তোমাদের শক্তির সঙ্গে ওদের শক্তিও যোগ কর তাহলেই রখ তার গতি ফিরে পাবে। অনেক টালবাহানার পর সমাজে পিছিয়ে থাকা অচ্ছুৎ অন্ত্যজদের রথের রশি ধরার অনুমতি মিলল। সমাজের অন্য সবার শক্তির সঙ্গে যে মুহ,রতে যোগ হলো তথাকথিত অন্ত্যজদের শক্তি- সবাইকে অবাক করে দেবতার রখের চাকা তখনই সশব্দে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
Joy baba jagannath