অন্তর মম বিকশিত কর, অন্তরতর হে
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে
জাগ্রত করো, উদ্যত কর, নির্ভয় করো হে
মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।।
কালজয়ী সৃষ্টি তাঁর! স্রষ্টার নাম নিশ্চই বলে দিতে হবে না! এই অভাগা বাঙালি যাঁর সাহিত্য, গান ছাড়া অসম্পূর্ণ…
এক এবং অদ্বিতীয় বাঙালির প্রাণের কবি, মনের কবি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাংলার নতুন বছর এলেই আমরা বাঙালিরা যে দিনটির অপেক্ষা করি, সেটা হল ২৫ সে বৈশাখ। ১২৬৮ বঙ্গাব্দে, ইংরেজির ১৮৬১ সালের ২৫ বৈশাখের দিনে বাংলায় ভূমিষ্ট হয়েছিলেন সাহিত্যের ভগবান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন অপরিসীম সাহিত্য প্রতিভা সম্পন্ন এই মহান ব্যক্তি।বিশ্বকবির সাহিত্য, গান নিয়ে যতই আলোচনা করি, কম পড়ে যাবে। আর এ বিষয়ে বাঙালি যথেষ্ট অবগত বটে। কারণ ১৬৩ বছর পরেও বাঙালির হৃদয়ের অন্তরে স্বমহিমায় রয়েছেন কবিগুরু। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না
কিন্তু আমরা যতই তাঁর সম্পর্কে জেনে থাকি, রবি ঠাকুরের সৃষ্টি কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের আরও কাহিনী জানার কৌতহল আমদের চিরস্থায়ী। তাঁর সম্পর্কে এমনই বেশ কিছু অজানা তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরব ।
ভারতের ‘জণ গণ মন অধিনায়ক জয় হে’ এবং বাংলাদেশের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ দুটি জাতীয় সংগীতই কবিগুরুর লেখা। কিন্তু এছাড়া আরও এক দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর সৃষ্টি জড়িয়ে রয়েছে। ভারতের অপর এক প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতে রবি ঠাকুরের সৃষ্টির ছোঁয়া রয়েছে। শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুরের শিষ্য আনন্দ সিমারানকুল ,যিনি শ্রীলঙ্কার নাগরিক, রবিঠাকুরের গীতবিতানের একটি গানের অনুকরণেই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত রচনা করেছিলেন, যা হল- ‘মাতা শ্রীলঙ্কা, নম নম নম নম মাতা, সুন্দর শ্রী বরনী।’
আমরা প্রায় অনেকেই জানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাঁচটি ছদ্মনাম আছে। যা হল যথাক্রমে ভানুসিংহ, আন্নাকালী পাকড়াশী, অকপটচন্দ্র লস্কর, দিকশূন্য ভট্টাচার্য এবং ষষ্ঠীচরণ দেব শর্মা।কিন্তু এটা এছাড়াও অনেকগুলো ছদ্মনাম তিনি ব্যবহার করতেন যা অনেকের অজানা, তা হল- নবীন কিশোর শর্মণ, বাণীবিনোদ বিদ্যাবিনোদ, শ্রীমতী কনিষ্ঠা, শ্রীমতী মধ্যমা। ১৯২৪ সালে ৮ মে কবিগুরু তাঁর ৬৩ তম জন্মদিন পালন করেছিলেন চিন দেশে। তাঁর সম্মানার্থে সেই দেশের সরকার তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘চু চেন তাং’
‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’
এই গানটিই রবি ঠাকুর লেখা প্রথম গান, সেটা হয়তো অনেকেই জানেন। কিন্তু এই গানের নেপথ্যে কী ইতিহাস ছিল সেটা জানেন কি?১৮৭৩ সাল, কবিগুরুর বয়স তখন ১১ বছর। কয়েকমাসের জন্য তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। এর মধ্যে হিমাচল প্রদেশের হিমালয় পাহাড় ঘেরা ডালহৌসি শহরে থাকাকালীন বাবার কাছে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের নিয়মিত পাঠ নিতেন।ওই সময় অমৃতসরে এক মাস ছিলেন তাঁরা। বাবা ও ছেলে নিয়মিত যেতেন স্বর্ণমন্দিরে। সেখানকার পাঞ্জাবী ভজন রবি ঠাকুরের মনে দাগ কেটেছিল। এরপরই তিনি লিখে ফেললেন ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ । মাত্র ১১ বছর বয়সে রচনা করলেন প্রথম গান। এটি ছিল পাঞ্জাবি একটি ভজনের অনুবাদ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ তে লিখেছেন, সেসময় ওই মন্দিরের ভজন সঙ্গীত তাঁর চিন্তাধারণার উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল।
শুধু সাহিত্য, সঙ্গীত প্রীতিই নয়, খেলাধুলাতেও সমান উৎসাহ ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতেছিল মোহনবাগান। সেই ঐতিহাসিক জয়ে এত উচ্ছসিত হয়েছিলেন কবি, যে একটা কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন তিনি।
‘দে গোল… গোল…’।
কবিতাটির দু-লাইন…
ওরা ব্রিটিশের সাথে খেলিল আজিকে,
জেদের খেলা
বিকাল বেলা
মাঠে লাখো লোক করে থিকথিক
ফুটবলই আজ বাঁচার প্রতীক
কবিতাটি আজও মোহনবাগান দিবসে অনেক জায়গাতেই চালানো হয়। রবি ঠাকুরের এই গান যেন সেদিনের জয়কে অমর করে দিয়েছে।এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোটবেলায় প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি কুস্তিবিদ্যাও শিখতেন। তাঁর কুস্তি শিক্ষকের নাম ছিল হিরা সিং।
যে ঠাকুর পরিবারে জন্মেছিলেন রবি ঠাকুর। জানেন কি, সেই পরিবারের প্রাথমিক পদবী কিন্তু ‘ঠাকুর’ ছিল না। প্রথমদিকে ‘কুশারী’ ছিল ওনাদের বংশগত পদবী। পরে কলকাতায় এসে ‘কুশারী’ পদবী বদলে নতুন ‘ঠাকুর’ পদবী গ্ৰহণ করেন রবি ঠাকুরের পূর্ব পুরুষরা।
এবার যে প্রসঙ্গে আসতে চলেছি, যার জন্য কবিগুরু এই বিশ্বের কাছে বাংলার এক অনন্য মাত্রা তৈরি করে দিয়েছিলেন সেকালেই। ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি তথা প্রথম ভারতীয় তথা প্রথম এশিয়াবাসী হিসাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যা বাঙালির কাছে আজও অত্যন্ত গর্বের বিষয়।
গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ Song Offerings -এর জন্য সাহিত্যে নোবেলজয়ী হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এতটা পর্যন্ত সবাই জানে।
কিন্তু জানেন কি তাঁর গীতাঞ্জলির পান্ডুলিপি নোবেল কমিটিকে জমা দিতে যাওয়ার সময় কী ঘটনা ঘটেছিল?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু উইলিয়াম রথেনস্টাইন ১৯১১ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আসেন। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে রথেন্সটাইনের যোগাযোগ বাড়ে, রথেন্সটাইন বার বার কবিকে বিভিন্ন গল্পের , কবিতার ইংরেজি পাণ্ডুলিপি চেয়ে পাঠান এবং বহুবার কবিকে লন্ডনে আসতে অনুরোধ করেন। ১৯১২ সালের মে মাসে রবি ঠাকুর ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন।
১৯১২ সালে, ১৫ জুন বিশ্বকবি লন্ডন যাওয়ার উদ্দেশে ডোভার থেকে ট্রেনে চড়েন, সেই অভিযানে সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্র-বধূ প্রতিমা ও বন্ধুসম ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য সৌমেন্দ্রদেব বর্মন।পরেরদিন কবি খেয়াল করেন গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি যে সুটকেসে নিয়ে এসেছিলেন সেই সুটকেসটাই নিখোঁজ।
বহু খোঁজাখুঁজির পর কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথ যখন পুলিশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন, তখন রবি ঠাকুর তাঁকে লন্ডন মেট্রোরেলের নিখোঁজ সামগ্রীর অফিসে গিয়ে একবার খোঁজ নেওয়ার কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত লন্ডন মেট্রোরেলের অফিসে গিয়ে সুটকেসটির খোঁজ মেলে । যার ভেতরে গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি অক্ষত ছিল বলেই জানা যায়। তারপর পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়ে নোবেল কমিটিতে জমা দেওয়া হয়। বাকিটা তো ইতিহাস।
রবি ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার প্রসঙ্গে এত কথা যখন বলা হল, তখন এটাও জানিয়ে রাখি নোবেল পুরস্কার পেয়ে তিনি কী করেছিলেন।
নোবেল পুরস্কারের প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তিনি কৃষকদের সুবিধার্থে ‘পতিসর কৃষি ব্যাঙ্ক’ নামে একটা ব্যাঙ্ক তৈরি করেছিলেন। বাড়ীর পাশাপাশি এলাকার সেতু, সাঁকো মেরামত করেছিলেন। অর্থাৎ মানুষের সেবায় তাঁর পুরস্কারের টাকা উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক, তার কোনও অন্ত হতে পারে না। বহু প্রতিভা সম্পন্ন এক মহান ব্যক্তিত্ব আমাদের প্রিয় রবি ঠাকুর।‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে নিও না সরায়ে’…. তাঁর চরণ স্পর্শ করার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি, তবু মনে মনে তাঁর চরণে শত কোটি প্রণাম। বাঙালির হৃদয়ে অমর তুমি রবীন্দ্রনাথ!